জয়পুরহাট থেকে ফারহানা আক্তার,
জয়পুরহাটে হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে রোটা ভাইরাস বা ই-কলাই জনিত ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। প্রতি দিনই চিকিৎসা নিতে প্রায় ৬০ জন আক্রান্ত শিশু ও বয়স্করা ছুটে আসছেন জেলা সদরের আধুনিক হাসপাতালে। গত এক মাসে এই হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগে শিশুসহ প্রায় দুই হাজারের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। জেলার ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় পঁাচশত জন। বাকীরা বিভিন্ন ক্লিনিক,ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে,ডাক্তারের চেম্বারে। অধিকাংশরাই বাড়িতে নিজেরা স্যালাইন খেয়েই ভালো হয়ে গেছে। বাড়িতে স্যালাইন খেয়ে যাদের ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ হয় নাই শুধু তারাই হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু।
রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত ওয়ার্ডে (বেডে) স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাধ্য হয়ে রোগীদের অধিকাংশকেই হাসপাতালের বারান্দা কিংবা করিডোরের মেঝেতে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। ডায়রিয়াক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে এ হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের। কিছুতেই ডায়রিয়ার প্রকোপ কমছে না। ডায়রিয়াক্রান্তদের কেউ মারা না গেলেও প্রায় প্রতিদিন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২/১ জন রোগীকে এ হাসপাতাল থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। গত প্রায় দেড় মাস ধরে চলছে এ অবস্থা। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, শীতের শেষে বছরের এ সময়টা আবহাওয়ার তারতম্যের পাশাপাশি অপরিস্কার অপরিচ্ছন্নতা কারণে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। একই কারনে প্রতি বছর এ সময় কমবেশী ডায়েরীয়ার প্রকোপ দেখা যায়। গত জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত নানা বয়সী প্রায় ২ হাজার ডায়েরীয়া রোগী ভর্তি হয়েছে জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালে। বুধবার হাসপাতালে ভর্তি ৫৭ জন ডায়রিয়া রোগীর মধ্যে ২৪ জনই শিশু।
জয়পুরহাট পৌর এলাকার বুলুপাড়া গ্রামের ৬ মাসের শিশুপুত্র আবদুল্লাহ্র পিতা জাহিদুল ইসলাম বলেন,আমার ছেলে মিনিটে ২-৩ বার পায়খানা করছে। যে খাচ্ছে তাই বের হয়ে যাচ্ছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার তুলাট গ্রামের ১০ মাসের শিশুপুত্র রমজান এর পিতা জাহেদুল আলম ও একই উপজেলার কয়তাহার গ্রামের ১৫ মাসের শিশুপুত্র জাকারিয়া এর পিতা রুবেল হোসেন জানান, পাতলা পায়খানা ও বমি শুরু হয়। স্যালাইন খাওয়ার পরও ভালো না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করায়। তবে এখন একটু কমে গেছে। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার খিয়ারপুর গ্রামের হোসেন আলী,নওগাঁর ধামুইরহাট উপজেলার মর্জিনা বেগম ও বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, প্রথমে বমি ও পরে পাতলা পায়খানা আর পেটের ব্যথায় ভুগেন, পরে অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।
হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের কর্তব্যরত সিনিয়র ষ্টাফ নার্স (সেবিকা) নাসিমা সুলতানা জানান, প্রতিদিন এক দিকে সুস্থ হয়ে এক দল বাড়ি চলে যাচ্ছে,অন্য দিকে চিকিৎসা নিতে নতুন করে এসে ভর্তি হচ্ছে।এমনি ভাবে গড়ে ৫০ জনেরও বেশি নতুন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালে নতুন ও পুরনো মিলে সব সময় ৬০ থেকে ৭০ জন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়ে থাকছে।’ হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডটি করোনা চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়। ফলে ছোট ২টি ঘরে মাত্র ৫টি বেডে ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসাদেওয়া হচ্ছে। বাকীদের করিডোর ও বারান্দার মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। শিশুসহ সব শ্রেনীর রোগীই হাসপাতালে আসছে। মূলত রোটা ভাইরাস বা ই-কলাই জীবাণু থেকে ডায়রিয়া হচ্ছে। খাদ্যাভাস পরিবর্তন ও পানি কম খাওয়ার কারণেও ডায়রিয়া হতে পারে। খাবার আগে হাত সাবান দিয়ে ধৌত করতে হবে। শৌচকাজ সারার পর ছোট থেকে বড় সবারই ভালোভাবে জীবানমুক্তকরণ সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও ডায়রিয়া হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। রোগীদের অতি প্রয়োজনীয় স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ঔষধসহ সার্বক্ষনিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে ২৪ ঘন্টা তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে এ অবস্থা কেটে যাবে।
জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল চিকিৎসক (আরএমও) ডাঃ মিজানুর রহমান মিজান জানান,‘গত দেড় মাস থেকে এ হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। তাদের চিকিৎসা দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। ডায়রিয়ার কারন হিসেবে মৌসুম পরিবর্তনে আমরা মনে করছি। সবাই যদি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে তাহলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি এ থেকে মুক্তি পেতে পারি।’ জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ ওয়াজেদ আলী জানান, বিভিন্ন ভাইরাস এর কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটছে, আবহাওয়ার তারতম্যের পাশাপাশি অপরিস্কার অপরিচ্ছন্নতাসহ নানা কারনে। মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। বছরের এ সময়টা আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ভাইরাস সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যা অস্বাস্থ্যকর খাবার ও দুষিত পানির মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এ রোগের সৃষ্টি করে।
Leave a Reply